সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪
ঢাকা সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
The Daily Post

ছোট হচ্ছে টেংরাগিরি বনাঞ্চল হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

বরগুনা প্রতিনিধি

ছোট হচ্ছে টেংরাগিরি বনাঞ্চল হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

ছোট হয়ে আসছে উপকূলীয় জেলা বরগুনার সংরক্ষিত বনাঞ্চল টেংরাগিরি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে পরিবেশ-প্রতিবেশের পরিবর্তন আর বনখেকোদের কবলে পড়ে ধীরে ধীরে উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চলটি। 

প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি টেংরাগিরি জলবায়ু পরিবর্তনের বরাদ্দ অর্থে গাছপালা কেটে বন সাবাড় করে নির্মাণ করা হয়েছে ইকোপার্ক। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ে তীরে, দন্ডায়মান বৃক্ষরাজির গোড়ার বালুমাটি সরিয়ে ফেলা, ঝড়-বন্যা- জলোচ্ছ্বাসে বনাঞ্চল লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া, স্থানীয় প্রভাবশালীদের জবরদখল ছাড়াও বনখেকোদের কাঠ চুরির ফলে ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ। হুমকির মুখে পড়ছে জেলার বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে গড়ে উঠা তালতলীর জীববৈচিত্র্য।

স্থানীয় বনবিভাগ সূত্র মতে, তালতলীর টেংরাগিরি সংরক্ষিত এই বনের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা টেংরাগিরি একসময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই ১৯২৭ সালের বন আইনের জরিপ অনুযায়ী  তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে। পরে ১৯৬৭ সালে এটিকে টেংরাগিরি বনাঞ্চল হিসেবে নামকরণ করা হয়। 

টেংরাগিরি বনাঞ্চলে সৃজিত গাছের মধ্যে রয়েছে গেওয়া, জাম, ধুন্দল, কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, করমচা, কেওয়া, তাল, কাঁকড়া, বনকাঁঠাল, রেইনট্রি, হেতাল, তাম্বুলকাটা, গরান ছাড়াও রয়েছে নানা প্রজাতির গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। আর এই সংরক্ষিত বনে রয়েছে হাজারো প্রজাতির প্রাণী। এদের মধ্যে রয়েছে, কাঠবিড়ালি, বানর, নানা প্রজাতির সাপ, শজারু, শূকর, কচ্ছপ, শেয়াল, ডোরাকাটা বাঘ, বনমোরগ, কাঁকড়া।

জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের বরাদ্দ অর্থে ইকোপার্ক-ইকোট্যুরিজম সুযোগ বৃদ্ধি শীর্ষক কর্মসূচির অধীনে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের দুই কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে বনের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে পিকনিক স্পট, ব্রিজ, ওয়াক ওয়েসহ যাত্রী ছাউনি ও বিভিন্ন পাকা স্থাপনা। 

স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বনের যে পাশ দিয়ে ইটের রাস্তা টেনে নিয়ে বিচে যাওয়া হয়েছে এই রাস্তাটি নির্মাণের সময় অনেকগুলো গাছ কেটে ফেলা হয়েছিল। এ ছাড়াও বনের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করায় বেড়েছে মানুষের আনাগোনা। ফলে বন্যপ্রাণীরা তাদের নিরাপদ আবাসস্থল থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নলবুনিয়া, নিশানবাড়িয়া, আশারচর ও নিদ্রা-সখিনা এলাকায় মড়ক ও নিধন দুটোই রয়েছে। দূর থেকে ঘন বন মনে হলেও চোরাকারবারিদের কারণে ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে। কয়েক কিলোমিটার এলাকার বনের গাছ সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে গেছে। আরও অসংখ্য গাছের বাকল ও ডালপালা ছেঁটে ফেলায় সেসব গাছ মৃত্যুর প্রহর গুণছে। নিদ্রা ও আশারচর এলাকায় কয়েক হাজার গাছ কেটে সাবাড় করার পর পড়ে আছে সেসব গাছের গোড়া। এসব গাছ মরার অন্যতম কারণ গোড়ায় বালু জমে যাওয়া। বালুতে ঢাকা পড়েছে এসব গাছের শ্বাসমূল। 

টেংরাগিরি বনের দক্ষিণ দিকের শেষ সীমানায় সোনাকাটা সৈকতের বালিয়াড়িতে অসংখ্য মৃত রেইনট্রি, কেওড়া ও ছৈলা গাছ মুখথুবড়ে পড়ে আছে। বঙ্গোপসাগরের প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে আরও অসংখ্য গাছের গোড়ার মাটি সরে গিয়ে শিকড়-বাকড় বের হয়ে গেছে। বালুতে এসব গাছের শ্বাসমূল ঢাকা পড়েছে। গাছগুলোর পাতা ও কান্ড হলদেটে হয়ে গেছে। ঢেউ ও জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্লাবন ভূমির আওতা বেড়ে যাওয়ায় বনের মধ্যে জোয়ার ঢুকে ভূমির ক্ষয় ত্বরান্বিত করছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, গাছ মরার পাশাপাশি বন উজাড় হওয়ার আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে কাঠচোরদের উৎপাত। 

তারা আরও বলেন, নিদ্রা, সখিনা, আশারচর, নলবুনিয়া বনসংলগ্ন গ্রামগুলোতে অনেক চোরচক্র সক্রিয় রয়েছে। এরা বিভিন্ন চোরাকারবারি ও বনরক্ষীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বন উজাড় করছে। কেওড়া ও গেওয়াগাছ চেরাই করে জ্বালানি কাঠ এবং সুন্দরীগাছ গৃহনির্মাণ ও আসবাব তৈরির কাজে ব্যবহার হয়। চার-পাঁচ বছর আগেও জোয়ারের পানি সৈকতের কাছাকাছি থাকত। এখন তা বনের তিন-চার কিলোমিটার পর্যন্ত ঢুকে পড়ছে। এতে বনের গাছগাছালির গোড়ার মাটি ক্ষয় হয়ে গাছের অস্তিত্ব বিপন্ন করছে। বনভূমি রক্ষায় শিগগিরই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পুরো বন হুমকিতে পড়বে।

টেংরাগিরি, হরিণঘাটাসহ ছোট বড় সব বনাঞ্চল নিয়ে বরগুনায় ৭৫ হাজার একর বনভূমি রয়েছে। এরমধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে ৩০ হাজার একর। বিশাল এই বনভূমি সুরক্ষার জন্য বরগুনার ছয়টি উপজেলায় দুটি বিট অফিস ও ১০টি ক্যাম্প অফিসে বনের সুরক্ষায় বনরক্ষী আছে মাত্র ২১ জন। শুধুমাত্র লোকবল সংকট নয়, অধিকাংশ ক্যাম্প অফিসগুলোর অবস্থা বেহাল। বন পাহারা দেয়ার জন্য নেই পর্যাপ্ত যানবাহন। 

বরগুনা জেলা পর্যটন উদ্যোক্তা উন্নয়ন কমিটি সভাপতি অ্যাডভোকেট সোহেল হাফিজ জানান, জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বাঁচতে। অথচ এই প্রকল্পের বরাদ্ধ অর্থের মাধ্যমেই গাছ উজাড় করে বিপন্ন করা হচ্ছে পরিবেশ। এতে করে বিপন্ন এই উপকূলে আরও বেশি প্রকট হবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রত্যাশা থাকবে যখন জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অধীনে কোনো প্রকল্প নেয়া হয়, সেই প্রকল্পটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে তারপর যেন অর্থছাড় করা হয়।

পটুয়াখালী বিভাগীয় বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, টহল কার্যক্রম জোরদারের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ জনবল সংকট রয়েছে। জনবল সংকট কেটে গেলে বনের সুরক্ষায় থাকবে বন বিভাগ।

টিএইচ